একুশের রক্তিম স্মৃতি: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো


আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

এই গানটির কথায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে সাংবাদিক লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন প্রথমে আবদুল লতিফ গানটি সুরারোপ করেন তবে পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে, ১৯৫৪ সালের প্রভাত ফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি এবং এটিই এখন গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তাঁর 'জীবন থেকে নেওয়া' চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়

গানের কথা

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
 আমি কি ভুলিতে পারি
 ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া ফেব্রুয়ারি
 আমি কি ভুলিতে পারি
 আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
 আমি কি ভুলিতে পারি।।
 জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
 শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
 দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
 একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি
 সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
 রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
 সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
 ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
 ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
 ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
 ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
 একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
 তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
 আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
 আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
 জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
 দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
 একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
প্রকাশ
গানটি একটি খবরের কাগজের শেষের পাতায় একুশের গান শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয় তখন গীতিকারের নাম ছাপা হয়নি পরবর্তীতে অবশ্য গীতিকারের নাম ছাপা হয় ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে
রচনার ইতিহাস
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয় সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে' এটি প্রকাশিত হয়
তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল গানটি গাওয়া লেখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১জন ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছিল
১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরি'তে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো
বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান
ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায় বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post